অনেকদিন ধরেই শরীর ভাল যাচ্ছিল না ‘নেতাজি’ মুলায়ম সিং যাদবের। গুরুগ্রামের মেদান্ত হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। সোমবার সকালে সেই লড়াই থামল। প্রয়াত সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুলায়ম সিং যাদব (mulayam singh yadav)। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। রাজনীতির একটি বর্ণময় অধ্যায়ের শেষ হল। ভারত (india) থেকে হয়ত চিরতরে মুছে গেল রাম মনোহর লোহিয়াপন্থী সামজবাদ (lohiaist socialist politics)। জাতপাতে দীর্ণ ভারতীয় সমাজকে মূলস্রোতের রাজনীতিকরা পাত্তা দিতে চাননি। সকলকে নিয়ে চলতে গিয়ে এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করছিলেন তাঁরা। বামপন্থীরা জাতপাতকে শ্রমিকের দৃষ্টিটে বিচার করছিলেন। সেখানে রাম মনোহর লোহিয়াই প্রথম বলেন কাস্ট ইজ ইকুয়াল টু ক্লাস। এভাবে ভারতের জাতপাতকে শ্রেণিবৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেছিলেন লোহিয়া। সেই রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন মুলায়ম। শেষদিন পর্যন্ত সেই রাজনীতিতে অটল থেকেছেন তিনি।
বর্ণময় মুলায়ম সিং যাদবের নানা দিক। দু’টি বিয়ে। কলেজের শিক্ষকতা। কুস্তিগীর। রাজনীতিতে নাম লেখানো। রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আরও কত কত দিক জড়িয়ে রয়েছে মুলায়মকে ঘিরে। রইল মুলায়মের নানা দিক—
সাইফাই অনুষ্ঠান, বিতর্ক: ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশেরর এটাওয়া জেলার সাইফাই গ্রামে জন্ম মুলায়মের। এই সাইফাইতেই পরবর্তী সময়ে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। থাকতেন বলিউডের প্রথম সারির তারকারা। সুরকার এ আর রহমান থেকে অমিতাভ বচ্চন, কে যাননি সাইফাইতে? সেই নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি।
কলেজ শিক্ষক মুলায়ম: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর তিনটি ডিগ্রি রয়েছে। মৈনপুরি জেলার কারহালের জৈন ইন্টার কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে এই মৈনপুরীকেই তাঁর রাজনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলবেন তিনি। মৈনপুরীর সাংসদ ছিলেন।
কুস্তিগীর মুলায়ম: মুলায়মের বয়স তখন ২০ বছর। ষাটের দশক। কুস্তিগীর আখড়ায় নামকরা কুস্তিগীরদের নানা প্যাঁচে কুপোকাত করছেন ছোটখাটো চেহাড়ায় মুলায়ম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এটাওয়ার যশবন্ত নগরের সোশ্যালিস্ট পার্টির বিধায়ক নাথু সিং। মুলায়মকে দেখে তাঁর ভালো লেগে যায়। তিনি যখন জানতে পারলেন, মুলায়ম কলেজ শিক্ষক। তখন তিনি মুলায়মকে তাঁর রাজনৈতিক শাকরেদ করে নেন। এভাবেই রাজনীতিতে আসেন ‘নেতাজী’।
রাজনীতিক মুলায়ম: ১৯৬৭-র বিধানসভা নির্বাচনে যশবন্ত নগর কেন্দ্রে মুলায়মকে প্রার্থী করে সোশ্যালিস্ট পার্টি। মুলায়মের প্রার্থী হওয়ার জন্য নাথু সিং আর প্রার্থী হননি। ২৭ বছর বয়সে বিধায়ক হন তিনি। দশ বছর পর রাজ্যের মন্ত্রী হন তিনি। জরুরি অবস্থার সময় তিনি ১৯ মাস জেল খাটেন। ১৯৮০ সালে জনতা দল ভেঙে যায়। একটি শাখার নাম লোক দল। সেই দলের সভাপতি হন মুলায়ম। ১৯৮৯ সালে তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। তবে মাত্র দু’বছরের মাথায় ১৯৯১ সালের এপ্রিলে তাঁর সরকারের পতন হয়। পরের বছর তিনি সমাজবাদী পার্টি নামে দল গঠন করেন।
দীর্ঘদিন তিনি সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করতেন। তাই রাজনৈতিক দলের চিহ্ন হিসেবে সাইকেলকেই বেছে নেন।
নব্বইয়ের দশক থেকেই কমণ্ডুল বনাম মণ্ডল রাজনীতি ঘুরপাক খেতে থাকে। একদিকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান, অন্যদিকে মণ্ডল কমিশনের সংরক্ষণের রাজনীতি। লালুপ্রসাদ যাদবকে সঙ্গে নিয়ে নিয়ে তিনি ওবিসি রাজনীতির নেতৃত্ব দিতে থাকেন গোটা দেশে। যাদব-মুসলিম সমীকরণ তৈরি করে ১৯৯৩ সালে তিনি আবার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। আই কে গুজরাল মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন তিনি। অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের এক ভোটে পরাজয়ের পর সোনিয়া গান্ধী জোট সরকারের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। মুলায়মই প্রথম সোনিয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখনও সেই প্রশ্ন সোনিয়াকে তাড়া করে বেড়ায়।
করসেবকদের উপর গুলি: রামমন্দিরের দাবিতে ১৯৯০ সালে সোচ্চাার হয়ে ওঠে উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা দেশ। অযোধ্যায় হাজির হনন লাখো করসেবক। শান্তি-শৃঙ্খলার অযুহাতে মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব গুলি চালনার নির্দেশ দেন। ৩০ অক্টোবর সরকারি মতে ২৮ জনের মৃত্যু হয়। তবে বেসরকারি মতে সংখ্যাটা ৫৬। এরপরই ‘মুল্লা মুলায়ম’ তকমা পান তিনি। সেই গুলি চালনা নিয়ে তিনি কোনও আফশোস করেননি।
দু’টি বিয়ে, সাংসারিক অশান্তি: মালতী দেবীকে বিয়ে করেন তিনি। তবে অখিলেশ যাদবের জন্ম দেওয়ার সময় থেকে তিনি স্থবির হয়ে যান। ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মালতীদেবী স্থবির ছিলেন। ১৯৯০ সাল থেকেই সাধনা গুপ্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। গোপনে বিয়েও সারেন। ২০০৭ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টে বিয়ের কথা স্বীকার করেন। সাধনার প্রথম পক্ষের একটি ছেলে রয়েছে। প্রতীক যাদব। তাঁর স্ত্রীর নাম অপর্ণা যাদব। অপর্ণা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
0 মন্তব্যসমূহ