The First Woman Cardiologist In India
প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে যাবেন একজন একশ বছর উত্তীর্ণ মহিলাকে দেখে। অভিজাত ব্যবহার আর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরের এই অধিকারিণী মহিলা জয় করে নেবেন আপনার হৃদয়। দেখে মনেই হবে না, তিনি একশটি বসন্ত পার করে ফেলেছেন। তিনি দেশের প্রথম মহিলা কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ শিবরামকৃষ্ণ আইয়ার পদ্মাবতী ( S Padmavati)।
তাঁকে দেখে প্রথম প্রশ্নই জাগবে, এই বয়সেও স্বাস্থ্য ধরে রাখেন কী করে? হাসতে হাসতে পদ্মাবতীদেবী জানিয়ে দেবেন, সাঁতারের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁর সুস্বাস্থ্যের রহস্য। তিনি যে নিয়ম করে প্রতিদিন সাঁতার কাটেন, তাও জানাতে ভুলবেন না।
ভারত স্বাধীন হতে তখনও কয়েক মাস বাকি। সপরিবারে মায়ানমার থেকে ভারতে চলে আসেন পদ্মাবতী।
তখন থেকেই তিনি মনেপ্রাণে একজন ভারতীয় হয়ে ওঠেন। বলতে গেলে ভারতের উন্নতিই তাঁর ধ্যনজ্ঞান। ছোট থেকেই চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতি তাঁর অগাধ আগ্রহ। তখনকার দিনে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে গেলে কোনও প্রবেশিকা পরীক্ষা দিতে হতো না। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফলের দৌলতে সরাসরি ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হওয়া যেত। পদ্মাবতী জানিয়েছেন, মায়ানমার বোর্ডের স্কুল স্তরের পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার দৌলতে তিনি সরাসরি স্থান পান মেডিক্যাল পরীক্ষায়।
রেঙ্গুন মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস হওয়ার পর পদ্মাবতী পারি জমান ব্রিটেনে। ১৯৪৯ সালে তিনি এফআরসিপি সম্পূর্ণ করেন। তবে কে নিঃশ্বাসে যেভাবে বিষয়টি তুলে ধরা হল, আদতে বিষয়টি এত সহজ ছিল না। প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। পদ্মাবতীদেবীর ভাষায়, ‘যুদ্ধের পরে ব্রিটেনে বসবাস কঠিন হয়ে পড়েছিল। অধিকাংশ মানুষকে র্যা শনের উপর নির্ভর করে দিন কাটাতে হতো। র্যা শন দোকানের সামনে লম্বা লাইনই ছিল তৎকালীন ব্রিটেনে স্বাভাবিক ছিল।’ পদ্মাবতীকেও ন্যাশনাল হার্ট হাসপাতাল, ন্যাশনাল চেস্ট হাসপাতাল এবং কুইনস্কোয়ারের ন্যাশনাল হাসপাতালেও কাজ করতে হয়েছে।
আর এখানে কাজ করতে করতেই তাঁর কার্ডিওলজি বিষয়টির সঙ্গে পরিচয়। পদ্মাবতী জানিয়েছেন, সে সময় বিষয়টি ছিল একেবারেই নতুন। আর নতুনত্বের মোহে তিনিও কার্ডিওলজি নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। এফআরসিপি শেষ করার পরে তিনি এবার চললেন সুইডেন। স্টোকহোমে তখন কার্ডিওলজি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। তিনমাসের জন্য সুইডেনে ছিলেন পদ্মাবতী। সাদার্ন হাসাপাতালে তিনি আধুনিক কার্ডিওলজির উপর কোর্স করেন। সেই কোর্স করতে করতেই তিনি আমেরিকার বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালে পরবর্তী শিক্ষার জন্য আবেদন করেন। তাঁকে ফেলোসিপ দেয় এই বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর তাঁর ফেলোসিপ মঞ্জুর করেছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ হেলেন সুয়াং। ১৯৫২ সালে পদ্মাবতী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন। পদ্মাবতীদেবী জানিয়েছেন, যে তিনি সেই সময়ে হার্ভার্ডে ভর্তি হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন। কেননা, তখন হার্ভার্ডে পড়াচ্ছেন ডাঃ পল ডাডলে হোয়াইট। কার্ডিওলজির জনক বলা হয় তাঁকে। তাঁর সাফল্যের পিছনে ডাডলের অবদান এখনও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন পদ্মাবতী।
১৯৫৩ সালে তিনি ভারতে আসেন। লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। সেই হাসপাতালেই শুরু হয় তাঁর কর্মকাণ্ড। আমেরিকার রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকুল্যে তিনি দেশের মধ্যে প্রথম কার্ডিও সেন্টার খোলেন। অল ইন্ডিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন তৈরিতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৬২ সালে শুরু হয় এই সংস্থার কাজ। ফাউন্ডেশনের কাজেই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন তিনি। বিদেশে অর্জিত জ্ঞান, ভারতীয়দের সেবায় নিয়োগ করেন পদ্মবতী। তাঁর মনে হয়েছিল, ভারতীয়দের সমস্যা কিছুটা আলাদা। এখানকার জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারণ আলাদা হওয়ায় রোগের ধরণ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। তাই ভারতীয়দের চিকিৎসা করতে হবে, ভারতীয় রীতি মেনে। আর চিকিৎসার খরচও রাখতে হবে সকলের আয়ত্তের মধ্যে। এরপর শুরু হয় তাঁর হৃদরোগের সমস্যায় ভারতীয় সমাধান।
১৯৬৭ সালে তিনি যোগ দেন মৌলনা আজাদ মেডিক্যাল কলেজে। সে বছরই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ শিবরামকৃষ্ণ আইয়ার পদ্মাবতীকে পদ্ম ভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৭৮ সালে মৌলনা আজাদ মেডিক্যাল কলেজ এবং সহযোগী হাসপাতালের ডিরেক্টর এবং প্রিন্সিপাল পদ থেকে অবসর নেন। তবে অবসরের পব নিভৃতে সময় কাটানোটাই যেখানে ভারতে দস্তুর, সেখানে পদ্মাবতীদেবী ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরও বড় কাজে। দক্ষিণ দিল্লির অল ইন্ডিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনের অধীনে তিনি গড়ে তোলেন ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট। ১৯৮১ সালে সকলের চিকৎসার জন্য খুলে দেওয়া হয় এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে হার্ট ইনস্টিটিউটের আরও দু’টি শাখা খুলে দেওয়া হয়। পদ্মাবতীর তত্ত্বাবধানে প্রতি বছর আশপাশের পাঁচ থেকে ছ’টি হৃদরোগের পরীক্ষার জন্য ক্যাম্প খোলা শুরু হয়। বেশ কিছু রোগীকে বিনামূল্যে দেওয়া হয় পেসমেকার। হার্ট ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে এই প্রথা এখনও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
১৯৯২ সালে পদ্মাবতীকে পদ্ম বিভূষণে সম্মানিত করে ভারত সরকার। সারা জীবনে বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য পত্রিকায় ৩০০-র বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন।
এই বয়সেও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন পদ্মাবতী। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দিনের আঠের ঘণ্টা কাজ করেছেন তিনি।
শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে নিজের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ রাখেননি পদ্মাবতী। জীবনকে চালিত করেছেন নিজের মতো করে। বেঁচেছেন নিজের শর্তে। তাই তাঁর দীর্ঘ জীবনের উপান্তে এসে প্রযুক্তিকে আয়ত্ব করতে চেয়েছিলেন। শিখেছিলেন ডিজিটাল ইমেজ ইমপেন্টিং, ভিশন বেসড ফ্যাব্রিক ডিফেক্ট ডিটেকশন, নাম্বার প্লেট রিকগনিশন, ভেহিক্যাল ডিটেকশন অ্যান্ড স্পিড এস্টিমেশন, ট্রাফিক কনজেশন অ্যানালিসিস, ফেস রিকগনিশন, ভেহিক্যাল ডিটেকশন বেং স্পিড এস্টিমেশনের উপর নানা প্রোজেক্ট করেছেন। তাছাড়া সাঙ্কেতিক ভাষা, মুখের ছবি থেকে বয়স নির্ণয়ের মতো কাজেও তিনি প্রাথমিকভাবে দেশকে দিশা দেখিয়েছেন।
একবিংশ শতকে দেশের চিকিৎসা পদ্ধতি ক্রমশ প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকছিল। প্রযুক্তিকে কখনও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্তরায় মনে করেননি পদ্মাবতী। তাই নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রযুক্তি সংক্রান্ত নানা কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন তিনি। ২০০১ সালে বায়ো ইনফরমেশন অ্যালগারিদমের ব্যবহার নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিলেন। ২০০৬ সালে নবীন গবেষকদের জন্য তিনি আয়োজন করেছিলেন অনলাইন প্রোজেক্ট কনটেস্ট— ‘জেনেসিস ০৬’।
0 মন্তব্যসমূহ